বহুদিন কেউ চাল ভিক্ষা চায় না। আগে আমাদের বাসায় মটকিতে চাল রাখতো। সেখানে থেকে অর্ধেক পটে করে প্রতি ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেয়া হতো। কতো দূর দূরান্ত থেকে কতো কতো মানুষ ভিক্ষা নিতে আসতো। “মাইগো চাইল্যা ভিক্ষা দিবেন” ডাক শুনলে মায়ের আগে আমি দৌড় দিতাম। মটকি থেকে উপুর হয়ে পট ভরে চাল তুলতাম। দুপুরবেলা কেউ ভিক্ষা করতে আসলে আমার মা মাঝে মাঝে ভাত খেতে দিতেন। আমি পাশে বসে থাকতাম। কাউকে আবার কাজে লাগিয়ে দিতেন আমার মা। কাপড় ধুয়ে দাও, মশলা বেটে দাও। এটা ছিলো ভিক্ষুকদের এক্সট্রা ইনকাম। আমার বাবা ভিক্ষকদের ”তুমি” ডাকতে নিষেধ করতেন। আমার এখনো মনে আছে এক ভিক্ষুককে ”আপনি” না বলার কারণে আমি রাম থাপ্পর খেয়েছিলাম। তখন ভিক্ষুক অবশ্য অতো ছিলো না। কিছু কিছু বান্ধা (পরিচিত) ভিক্ষুক ছিলো যাদের সাথে আমার মায়ের বেশ খাতির ছিলো। তারা কুরচি (কাপড়ের থলে) ভরে ডিম বা শাক নিয়ে আসতো। মা মারা যাবার পর অনেক ভিক্ষুক এসে আমাদের বাসায় এসে কান্নাকাটি পর্যন্ত করেছে। আমি ভিক্ষুকবন্দনা লিখতে বসিনি, তবে এটা সত্য আজকাল ভিক্ষুকরা কাঁদলেও তাদের চোখে মায়া পাই না। তারা চাল চায় না টাকা চায়। টাকা না দিলে আবার গালাগালি করে। ’কাজ করে খেতে পারেন না’ বললে মুখ ভেংচি দেয়। ছোট ছোট বাচ্চারা ভিক্ষের ছুঁতোয় ছোট থেকেই ছলনা শিখছে। বড় হয়ে তারা কি হবে?
যুগ যুগ থেকে চলছে ভিক্ষা পেশা। এটা যে শুধু বাংলাদেশে আছে তা কিন্তু না, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখনো ভিক্ষাবৃত্তি আছে। অন্যের রোজগারে নিজে বেঁচে থাকবে এর চেয়ে আরামের জীবন কি আর আছে? একবার আমার এলাকা হবিগঞ্জের মাধবপুরের এক পরিচিতজনকে সিলেটে ভিক্ষা করতে দেখলাম। কাছে গেলাম, বললো আমাকে সে চেনে না। অথচ সেবছরই ঈদে দেখি সে সুন্দর বেশ ভূষায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। জানতে চাইলাম, কই থাকেন? সে বললো সিলেটে ছোটখাট ব্যবসা করে।আরেকটা গল্প বলি। একবার জিন্দাবাজারের ব্যস্ত সড়কে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। এক বোরকাওয়ালী মহিলা হাউমাউ করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, “বাবা আমার বাড়ি নীলফামারী, মাজারে এসে আমার স্বামী এখানে রেখে চলে গেছে। নীলফামারী যাবার টাকা নাই।” আমার সাথে ও দাঁড়িয়েছিলো। বললো, “দিয়ে দেন কিছু টাকা” আমি দুটো পাঁচশটাকার নোট দিয়েছিলাম। পরদিন একেটু দূরেই দেখি সেই নীলফামারীর মহিলা। আমি তার কাছে যেতেই বললো সে আমাকে চেনেনা। এভাবে ভিক্ষাবৃত্তির নামে প্রতারণাও কিন্তু চলছে।
বাঙালি অলস জাতি। দেশ স্বাধীন হবার পর যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশ নির্মাণে আমাদের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী দেশে দেশে ঘুরে অর্থ ভিক্ষা করে এনেছেন। গরীব ভিক্ষুকদের হয়তো দোষ দিয়ে পার পাওয়া যাবে, কিন্তু শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাটা জানেন? এদের পরিশ্রমের জায়গাটা কোথায়? যে প্রসঙ্গে ছিলাম- ভিক্ষাবৃত্তি। একদিনের মুসলমান বা একমাসের মুসলমান বাংলাদেশে অভাব নেই। বর্বর আইএস বা তালেবান থিউরি অনুযায়ী ইসলামের নামে মানুষ হত্যা জায়েজ অথচ নিজে ইসলাম মেনে যাকাত প্রদান করেনা এদেশের মুসলিমরা। কারণটা যে- "টাকা" । কে চায় নিজের টাকা অন্যকে বিলিয়ে দিতে? জিহাদ তো পরের বিষয় ভাইজান, যাকাত কিন্তু ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিধান। কোরানে আল্লাহ বলেছেন, “নামায কায়েম করো এবং যাকাত আদায় করো”। আপনি করছেন কি?
এক হিসাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের যাকাতযোগ্য সম্পদের পরিমাণ ১০ লক্ষ কোটি টাকা। এর আড়াই শতাংশ হারে যাকাতের পরিমাণ হয় ২৫ হাজার কোটি টাকা। ২৫ হাজার কোটির জায়গায় যদি ১২ হাজার কোটি টাকাও বছরে যাকাত আদায় হয়, চিন্তা করেন একটা ভিক্ষুক খুঁজে পাওয়া যাবে কি না।
বন্দরের ডায়বেটিস হাসপাতালে আরেক ভিক্ষুক পেয়েছিলাম। বুড়িটার নাম সখিনা বানু। জিজ্ঞেস করলাম "সারা দিনে কত ট্যাকা পান?" ফ্যাল ফ্যাল চোখে উত্তর দেন, "কোন কোন দিন ৬০/৭০, ভাগ্য বালা তাকলে ১০০ ট্যাকাও পাই। সবই কপালরে বাবা।" তার ছেলে তাকে ভাত-কাপড় দেয়না। এটা ছেলের দোষ নয়, এটা সখিনা বানুর কপাল। এরকম কপালকে দোষ দিয়ে এদেশের বোকা মানুষেরা আমৃত্যু সারাজীবন কাটিয়ে দেয়। মুখ দিয়েছেন যিনি আহারও দিবেন তিনি। তাই আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকবো, কাজ করবো না। ভাতের প্লেট সামনে নিয়ে বসে থাকবো কিন্তু হাত ধুয়ে মুখে খাবার উঠাবো না। ছিড়া ব্লাউজটা ঢেকে সখিনা জানালেন, পরনের শাড়িটা নাকি যাকাতের শাড়ি। এদেশে যাকাতের শাড়ি আছে, যাকাতের লুংগি-গামছা আছে। যে কাপড়গুলো এক ধোয়া দিলে ত্যানা ত্যানা। কি বুঝলেন?
পরিশ্রম করুন, ভাল কাজ করুন- অন্যদেরও সুযোগ করে দিন, সৎ পথে চলুন। ভাগ্য এমনিতেই বদলে যাবে। সকল ভিক্ষুক পূনর্বাসিত হোক।

লেখকঃ ফয়সল খলিলুর রহমান, কর্মকর্তাঃ সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
0 comments:
Post a Comment