Wednesday, July 20, 2016

বিচিত্র অভিজ্ঞতা!

সাংবাদিকতার বয়সতো কম হলোনা! ভালোমন্দ নানান অভিজ্ঞতা। তবে ভালো অভিজ্ঞতা, বিপুল সংখ্যক মানুষের নিখাদ ভালোবাসাই বেশি পেয়েছি-পাই। মন্দ অভিজ্ঞতাগুলোর কয়েকটা হলো রিপোর্ট-কলাম পছন্দ না হলে হলুদ সাংবাদিকতা, দলকানা ইত্যাদি অভিযোগ প্রায় শুনতে হয়! কারা এসব অভিযোগ করেন তাদের অনেককে ব্যক্তিগতভাবে চিনি জানি। আজকাল ফেসবুকের কারনে মাশাল্লাহ অন্যদের ওয়াল ঘুরে আসলেই বুঝতে পারি তার কাছে নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা  মাঝে মাঝে একটি অভিযোগ পাই টাকার! 
এ নিয়ে মজার একটি অভিজ্ঞতা বলি। দেশে আমার রিপোর্টিং'এর রাজনৈতিক বিট ছিল জাতীয় পার্টির। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবির আর স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে লিখতে লিখতে সাংবাদিকতায় হাত পাকিয়েছি। একবার এরশাদ দলের মিটিং'এ বললেন আমি যে তার বিরুদ্ধে লিখি এসব নাজিউর রহমান মনজুর টাকা দিয়ে আমাকে দিয়ে লেখায়! নাজিউরের সংগে তখন তার সাপেনেউলে সম্পর্ক। এরশাদ তার দূরনীতির অনেক সম্পদ নাজিউরের নামে করেছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার সংগে এরশাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক ভেংগে গেলে খালেদার পরামর্শে নাজিউর যখন বিজেপি নামের নতুন একটি রাজনৈতিক দোকান খোলেন, ওই সুযোগে তার কাছে তার নামে থাকা এরশাদের সব সম্পদ নিয়েও ভেগে যান! চুরির সম্পদতো তাই এরশাদ মুখ ফোটে এসব তার কাছে দাবিও করতে পারেননি। সেই মিটিং'এ জাপার এক নেতা এরশাদের মুখের ওপর একটা কথা বললে এরশাদ চুপ মেরে যান! ওই নেতা তাকে বলেন নাজিউর যদি ফজলুল বারীকে টাকা দিয়ে আপনার বিরুদ্ধে লেখাতো পারে, আপনি পারেননা কেনো? আপনার টাকা কী নাজিউরের চেয়ে কম? 
যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে করতে আমি সাংবাদিকতায় এসেছি। আমি যখন পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমন করছিলাম মাঠ পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে এ তথ্যগুলোই সংগ্রহ করতাম। এরজন্যে আমার ছোটখাটো একটি গৌরবের দাবি আছে তাহলো আমি সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম পর্যটক-সাংবাদিক। আগে পর্যটক নিজের মতো করে সারা দেশটা দেখা জানা এবং পরে সাংবাদিক। মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় ইতিহাস সংগ্রহের বিষয়টি আমাকে আমার মাতৃভূমি সম্পর্কে সমৃদ্ধ-আত্মবিশ্বাসী করেছে। আজকের বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কত মানুষের সংগে যে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল তার এলাকায়। হয়তো তখন তারা ছাত্র অথবা স্থানীয় নেতা। আরেকটা কথা মজা করে বলি। জিজ্ঞেস করি আপনি প্রথম ঢাকা এসেছিলেন কিসে চড়ে? ট্রেনে বাসে লনচে না বিমানে? আমি কিন্তু পায়ে হেঁটে ঢাকা এসেছি। আমার সংগ্রামটা ছিল অনেক বড়। 
এই সময়ের অন্যতম আলোচিত ব্লগার, লেখক, গণজাগরণ মনচের উদ্যোক্তাদের অন্যতম, বর্তমানে প্রাণ বাঁচাতে দেশান্তরী ও জার্মান প্রবাসী মাহমুদুল হক মুন্সি তথা আমার প্রিয় প্রজন্ম বাঁধনকে একদিন আমি মজার একটি গল্প বলেছিলাম। চুয়াডাংগায় যখন আমি পর্যটকের বেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহ করতে যাই তখন চুয়াডাংগার অনেকের সংগে সেখানকার কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সি আমাকে তার লেখা সহ নানা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন। এই হামিদুল হক মুন্সির ছেলে যে আমার বাঁধন তা সে না বললে আমার কী জানা হতো? এভাবে তার মাধ্যমে আমি তার বাবাকে আবার ফিরে পেয়েছি। এমন ঘটনা অনেক। আমি আরেক কারনে ভাগ্যবান যে জীবনে যখন যে কাগজে কাজ করেছি সবগুলোই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কাগজ। চিন্তার সংগে ঐক্যের কারনে এসব কাগজের কাজকে আমি সব সময় উপভোগ করেছি। নিয়মিত বেতন পাইনি, কিন্তু অফার থাকা স্বত্তেও মনের বিরুদ্ধে কোথাও কাজ করতে যাইনি। মনের বিরুদ্ধে যার কাজ করতে হয়, আমার কাছে সে ভাগ্যহীন। 
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আমার কাজগুলো খুব স্বাভাবিক বরাবর এনজয় করে, করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু কখনো তারা আমাকে ওউন করেনি। এ নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ নেই। গালমন্দ শোনাতে আমাকে একবার বত্রিশ নাম্বারের বাড়িতে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই প্রথম আমার সেই বাড়িতে যাওয়া। আমাকে যিনি গালমন্দ করতে ডেকে নিয়েছিলেন তার সংগে এখন আমার অনেক ভালো সম্পর্ক। আমার সিডনির বাসায়ও তিনি এসেছিলেন। শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়ার সংগে সারাদেশে অনেক ট্যুর করেছি আমি। কিন্তু কখনো তাদের সংগে বিদেশ সফরে যাইনি। তাদের সংগে বিদেশ সফরে যেতে যে যোগ্যতা লাগে তা আমার ছিলোনা। সবার সব যোগ্যতা থাকেনা। থাকতে হয়না। রিপোর্ট করতে আমার যাওয়া হয়েছে কুড়িটি দেশে। আমি কোথাও কোনদিন বেড়াতে যাইনি। কাজের জন্য গেছি। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় মর্যাদাকর প্রতিষ্ঠান প্রেসক্লাবও আমাকে সদস্যপদ দেয়নি। একবার আবেদন করেছিলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিএনপি কোন প্যানেল সুপারিশ না করাতে তারা আমাকে সদস্যপদ দেয়নি। এরপর আর কোনদিন আবেদন করিনি। আবদুর রহমান নামের প্রেস ক্লাবের তৎকালীন এক নেতা ক্লাবের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিতেন আমার মতো অসদস্য সাংবাদিক কেউ যাতে ক্লাবে ঢুকতে না পারে! 
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবিরাম লেখালেখির কারনে এক পর্যায়ে আমার বদনাম হয় ভারতীয় গোয়েনদা সংস্থা র'এ এসব আমাকে টাকা দিয়ে লেখায়! বিএনপির পত্রিকা দিনকালে এ নিয়ে একবার এক তালিকাও ছাপা হয়! সে তালিকায় বলা হয় র' প্রতিমাসে আমাকে পাঁচ হাজার টাকা করে দেয়! কিন্তু আমি যার অধীনে কাজ করি সেই তোয়াব খানকে মাসে দেয় তিন হাজার টাকা! রিপোর্টটি যিনি লিখেছিলেন তিনি অংকে কাঁচা হওয়াতে সেই রিপোর্টটি বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। আমার টাকা পাঁচ হাজার হলে তোয়াব খানের টাকা তিন হাজার হয় কী করে  উল্টো ভূয়া রিপোর্টের কারনে সেই রিপোর্টারের চাকরি চলে যায়! সেই রিপোর্টার পরে গোপনে ইসরাইল যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে ঢাকা বিমান বন্দরে গ্রেফতার হন। 
দুই হাজার সাত সাল থেকে আমি অস্ট্রেলিয়ায়। আমি এদেশের নাগরিক হিসাবে সরকার থেকে নানান সুযোগ সুবিধা পাই। এদেশে আমার চিকিৎসা সহ নানা কিছু ফ্রি। এখানে আমি প্রচুর কাজ করি। এসব কাজের আয়ের বেশিরভাগ নানাভাবে বাংলাদেশে যায়। বাংলাদেশে লেখালেখির মাধ্যমে যা আয় করি সে টাকাগুলোও আমি কোনদিন অস্ট্রেলিয়া আনিনি। ডলারে কনভার্ট করে তা পোষাবেওনা  দেশে আমার ওপর নির্ভরশীল অনেক অভাবগ্রস্ত মানুষ। লেখার টাকাগুলো তাদের কাজে লাগাতে পারলে ভালো লাগে আমার। 
এই আমার বিরুদ্ধে এখনো অভিযোগ আসে কারো পক্ষে বা বিপক্ষে লেখার বিনিময়ে টাকা কামাইয়ের  আমিতো এখানে ডলারে কামাই, আমাকে একজন কত টাকা দিতে পারবে বা তার কী সে সামর্থ আছে? চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আজিম রনির কারা মুক্তি নিয়ে লেখালেখির কারনে ইদানীং এই অভিযোগটি পাচ্ছি  অথচ এই ছেলেটির সংগে আজ পর্যন্ত আমার কথাও হয়নি। সে জামায়াত শিবিরের বিরুদ্ধে সোচচার, একজনের আক্রোশে পড়েছিল, এসব কারনেই তার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম। আর আমিতো তার পক্ষ নেই অনেকের অনেক পরে। বাংলাদেশের জন্মশত্রু জামায়াত-শিবিবের বিরুদ্ধে তাদের প্রতি প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে দূর্বল যে কারো বিরুদ্ধে আমি সোচচার ছিলাম। আগামীতেও থাকবো। টাকার জন্যে যারা কাজ করেন এ নিয়ে টাকার জন্য বদনাম ছড়ান না কেন, এক্ষেত্রে আমাকে থামাতে পারবেন না। এ কাজটি আমি আমার দায় মনে করি। এ দায় আমার জন্মভূমির প্রতি। মানুষের জীবনে টাকা অনেক দরকার। কিন্তু সবকিছু টাকাতে হয়না। সবকিছু সংগে টাকাটা মেলালে সে আর মানুষ থাকেনা। মনুষত্ব্য হারানো কেউ দেশের জন্যে কাজ করতে পারেনা। আমাকে সে সুযোগ থেকে বনচিত করতে চান? পারবেননা।

লেখকঃ ফজলুল বারী, সাংবাদিক। 

0 comments:

Post a Comment