Wednesday, June 15, 2016

প্রসঙ্গ জাসদঃ এখন অপেক্ষা ফলাফলের

স্বল্পভাষী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জাসদ প্রসঙ্গে যা বলেছেন, সেই বক্তব্য অনেকেরই। তিনি সেই অর্থে বহুজনের মনের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি আজ আমরা যা দেখছি, সেটি যেমন সত্য- তেমনই সত্য আমাদের রাজনীতির অতীত। সেই অতীতের দিকে তাকালে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কালকের বক্তব্য ইতিহাসের সত্য উচ্চারণ ছাড়া অন্যকিছু নয়। ইতিহাস নির্মম- সেখানে প্রশ্নচিহ্ন হয়ে আছে সদ্য স্বাধীন দেশে অতি বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড, আছে সংসদ সদস্য হত্যাসহ আরও অনেক রক্তপাতের ঘটনাসহ একটি সদ্য স্বাধীন দেশকে অস্থিতিশীল করার বিস্তারিত বিবরণ। এই ঘটনাগুলোর দায় জাসদ কখনোই এড়াতে পারবে না।

মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে রুশপন্থী কমিউনিস্টদের সাথে আওয়ামী লীগের বন্ধুত্ব ছিল প্রতিষ্ঠিত- জাসদ সাম্যবাদী দলসহ পিকিংপন্থীরা কখনোই ৭৫ পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের বন্ধু দলের অবস্থানে ছিল না। এই দলগুলো যত মানুষ ও ক্ষমতাহীন হয়েছে- তত বেশি আওয়ামী লীগমুখী হয়েছে। এ অনেকটাই শক্তিহীন হয়ে আশ্রয় নেয়া, শক্তিবান কালে বিবোধিতা- শক্তিশেষে আপসের দৃষ্টান্ত এরা।

অন্যদিক কমিউনিস্ট পার্টি বা ন্যাপ- এরা আওয়ামী লীগের সাথে বন্ধুত্বের পুরনো সাথী। বাকশাল থেকে খালকাটা সবই তাদের ইতিহাস। তবে খালকাটলেও তারা হয়তো সেই খালে কুমিরের সম্ভাবনায় ফিরে এসেছিল পুরনো বন্ধনে- ১৫ দল থেকে ৮ দল বা মোহাম্মদ ফরহাদের রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা সেই ইতিহাসের প্রমাণ। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পরে সিপিবির পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। এমনকি শেষ সংসদ নির্বাচন বর্জন ও পরবর্তী মেয়র নির্বাচনে যাওয়া। পল্টন থেকে শাহাবাগমুখী যাত্রা তারই ধারাবাহিকতা। সিপিবি বা অন্য পুরাতন বন্ধুদের শূন্যস্থানে আজ যোগ হয়েছে জাসদ সাম্যবাদী দল। আর নতুন বন্ধুর অতি উৎসাহ আর অতি কথনের বিষয়টিও আমরা দেখছি এই মহাজোট সরকারের শাসনকালে গত কয়েক বছরে ধারাবাহিক ভাবে।

বাজনীতি যখন অনেকটাই সংকটে, সংখ্যালঘুসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে যখন নিরাপত্তাহীনতা। কিছু নেতা মন্ত্রীর লাগামছাড়া কথায় যখন সাধারণ মানুষ কিছুটা বিরক্ত- ঠিক তখনি সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কথাগুলো আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। দল মানে মানুষ, সেই মানুষের জন্যই রাজনীতি- কিন্তু যে দলগুলো ক্রমেই মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন তাদের নেতারা যখন বড় কোনো পদ পান তখন অনেকটাই দিশেহারা হয়ে ওঠেন। জোটের প্রধান শক্তিকে তুষ্ট করাটাই হয়ে ওঠে তাদের প্রধান কাজ। নিজেকে বিশ্বস্ত প্রমাণে তাদের প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে মুখের কথা আর প্রশাসনিক শক্তি। তার কারণ নিজেদের অতীতের কর্মকাণ্ডকে ঢাকতে এছাড়া আর কোনো হাতিয়ার তাদের নেই।  যে কারণেই ভয়, কারণ অতীতকে বাদ দিলে ইতিহাস তার পরিপূর্ণতা পায় না- আর মানুষ কখনোই গোল্ডফিস নয়, এক্যুরিয়ামের এপাশ থেকে ওপাশে যেতে আসতে মানুষ তার স্মৃতি ভুলে যায় না। ভুলে যায় না বলেই আমাদের মনে আছে আমাদের অতীত। আমাদের মনে আছে আজকের প্রতিটি দরের অতীতের কাজগুলো।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ও তার পরে এদেশে যারা বৈজ্ঞাকি সমাজতন্ত্র কায়েম করেছেন। অথবা যারা খতমের রাজনীতি করেছেন তারা যতোই শুদ্ধতার কথা বলুক তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়, তাদের দায়মুক্তি মেলে না। কারণ মনে রাখা দরকার, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে দেশে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের সেই শক্তি ছিল না, যে শক্তিতে দেশকে অস্থিতিশীল করা যায়। সেই শক্তি ছিল উগ্র বাম ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের। স্বাধীন দেশে আলবদর বা রাজাকাররা না, অস্থিতিশীলতার মূল কারিগর ছিল জাসদ তথা উগ্র বামেরা। একদিকে সিরাজ সিকদারের খতমের রাজনীতি- অন্যদিকে জাসদের গণবাহিনীর সন্ত্রাসের মধ্যেদিয়ে ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত চলেছে ধারাবাহিক বিভিন্ন ঘটনা। গণকণ্ঠ কাগজটির ভুমিকা ছিল এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর জন্য প্রধান। দাদাভাই থেকে গণবাহিনীর ভূমিকা ইতিহাস নিশ্চয় মূল্যায়ন করতে দ্বিধা করবে না।

আজ বাংলাদেশ এক কঠিনকাল অতিক্রম করছে। একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তাদের দেশ আর বিদেশী স্বজনদের নানান অপতৎপরতা- অন্যদিকে দেশে জংগীদের হত্যার ধারাবাহিকতা। ব্লগার ধেকে পুরোহিত যাজক বা পুলিশ কর্মকর্তার পরিবার, সবার জন্যই নিরাপত্তাহীনতার কাল চলছে। অন্যদিকে শাসক দলের কাছে এই সময়ে যে রাজনৈতিক ভূমিকা প্রত্যাশিত, সেখানে সেই ভূমিকা কি আমরা দেখছি? এতো বড় সংগঠন থাকার পরেও আমরা আক্রান্তদের পাশে সরকারের বা শাসকদলের পদস্থ কারো দেখা নিকট অতীতে পাইনি। ফেনীর তুলসী রানীর পেটের সন্তানের লাথিতে মারা যাওয়ার পরে সেখানে দল আওয়ামী লীগ বা প্রগতিশীল কোনো সংগঠনের নেতাদের দেখিনাই। দেখি নাই সংসদের বা রাজপথের বিরোধীদলকেও। শাসকদলের পুলিশ নির্ভরতা আর বিরোধীদলের প্রেস কনফারেন্স নির্ভরতা সত্যিই হতাশাজনক। সাধারণ মানুষ রাজনীতিবিদদেরই ভরসা করেন- সে কারণেই তাদের প্রত্যাশা রাজনীতিবিদদের পাশে পাওয়ার। কিন্তু সেই প্রত্যাশা কি পূরণ হচ্ছে?

এই হতাশার কালে যখন গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে জাসদ নেতার বিষয়টি সামনে আসে, তখন সেই বক্তব্য আমদের ভাবিত করে। রাজনীতি যে শুধু কথামালা না- মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। এটি যতো দ্রুত শাসকদল বুঝতে পারবে ততই মঙ্গল। কথামালা দিয়ে বিরোধীদলের সমালোচনা করার জন্য অনেকই উপযুক্ত, কারণ শিততপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে উচ্চস্বরে টেলিভিশনের ক্যামেরাকে কথা যোগান দেয়ার চাইতে মাঠের নেতা-মাঠের রাজনীতিটা এখন জরুরি। আর সেই কারণেই আমার বিশ্বাস সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যটি এই সময়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ। এখন অপেক্ষা- ফলাফলের। দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে পরে দলের অবস্থানটি দেখার। আশা করি সেটি আমরা দেখবো।

অঞ্জন রায়: একটি বেসরকারি গণমাধ্যমে কর্মরত।
ই-মেইল: anjanroy.dhaka@gmail.com

0 comments:

Post a Comment